
১৯৪৭ইং সালে ১৪ই আগষ্ট সৃষ্টি হলো পাকিস্তান নামক একটি দেশ। পাকিস্তান সৃষ্টির ৭ দিন পরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুন শিক্ষক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে তিন সদস্য বিশিষ্ট “তমুদ্দুন মজলিস” গঠিত হয় যার উদ্দেশ্য ছিল বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। কিন্তু এ দাবী পাকিস্তানী শাষকগোষ্ঠি প্রত্যাখ্যান করে। বাংলা ভাষা বাদ উর্দু কে রাষ্ট্র ভাষা করার সিদ্ধান্ত চুড়ান্ত হয়।
১৯৪৭ইং সালের মে মাসে হায়দ্রাবাদে অনুষ্ঠিত এক উর্দূ সম্মেলনে সভাপতির ভাষনে কেন্দ্রীয় মুসলীম লীগ নেতা চৌধুরী খালেকুজ্জামান ঘোষনা করেন যে, “উর্দূই হবে পাকিস্থানের রাষ্ট্রভাষা।”
একই বছরের জুলাই মাসে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড: জিয়া উদ্দীন আহমেদও উর্দূর পক্ষে একই মত প্রকাশ করেন।
এ সময়ে ভাষাতাত্ত্বিক ড: মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ “আমাদের ভাষা সমস্যা” শিরোনামে এক প্রবন্ধে ড: জিয়া উদ্দীনের বক্তব্য খন্ডন করে বাংলা ভাষার পক্ষে জোড়ালো যুক্তি তুলে ধরেন।
রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে সৃষ্ঠ আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তৈরী হয়েছে দিনের পর দিন।

১৯৪৮ইং সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারী পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে পূর্ব বাংলার প্রতিনিধি কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দূ ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা কে পরিষদের ব্যবহারিক ভাষা হিসাবে গ্রহনের প্রস্তাব আনুষ্ঠানিক ভাবে উত্থাপন করেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এ প্রস্তাবের বিরোধীতা করে বলেন, পাকিস্তান মুসলিম রাষ্ট্র হওয়ার দরুন উর্দূই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হতে পরে।
১৯৪৮ইং সালের ১১ই মার্চ গঠিত পূর্ব বাংলা মুসলিম ছাত্রলীগ এক ইস্তেহারে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে এরুপ ষড়যন্ত্রের তীব্র প্রতিবাদ জানায়।

১৯শে মার্চ তৎকালীন গর্ভনর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসার ৩ দিন পর ২১ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক জনসভায় ঘোষনা করেন, “উর্দূ এবং উর্দূই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।”
তাৎক্ষনিক ভাবে এ ঘোষনার প্রতিবাদ জানানো হয়। এর ৩ দিন পর ২৪শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে এক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ একই ঘোষনার পুনরাবৃত্তি করলে উপস্থিত ছাত্ররা এ ঘোষনার তীব্র প্রতিবাদ জানায় এবং শ্লোগান দেয়
“না না বাংলাই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।”

ঢাকায় অবস্থান কালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ছাত্রদের সাথে ভাষা ও অন্যান্য সমস্যা নিয়ে একাধিকবার বৈঠকে বসে কিন্তু ভাষার প্রশ্নে তিনি আপোষ করতে রাজী হননি।
১৯৫০ইং সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান গনপরিষদে পাকিস্তানের ভবিষ্যত সংবিধান সস্পর্কে মূল নীতি কমিটির রিপোর্টে উর্দূকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবী করলে পূর্ব বাংলার জনগন তা প্রত্যাখ্যান করে।
এই দিকে ১৯৫১ ইং সালের আদমশুমারী অনুযায়ী বাংলা ভাষাভাষি লোকের সংখ্যা ছিল শতকরা প্রায় ৫৪.৬ ভাগ এবং উর্দূ ভাষাভাষির লোকের সংখ্যা ছিল শতকরা মাত্র ৬ ভাগ।

পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠি অন্যায় ভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগনের বাংলা ভাষাকে পদদলিত করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উর্দূ ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল।
১৯৫২ইং সালের ২৬শে জানুয়ারী তৎকালীন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল খাজা নাজিমুদ্দিন ঢাকার পল্টন ময়দানের এক জনসভায় ঘোষনা দেন,
“উর্দূই হবে পাকিস্তানের রাষ্টভাষা।”

ফলে ছাত্র-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী মহলে দারুন ক্ষোভের সৃষ্টি হয় এবং আন্দোলন তীব্র আকার ধারন করে। আন্দোলনের অংশ হিসাবেই ৩০শে জানুয়ারী ঢাকায় সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়ওয়ার মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। পরদিন ৩১শে জানুয়ারী ঢাকার বার লাইব্রেরী হলে কাজী গোলাম মাহাবুব কে আহবায়ক করে আওয়ামী মুসলিম লীগ, যুবলীগ, খিলাফত-ই-রাব্বানী পার্টি, ছাত্রলীগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদের সদস্যদের নিয়ে একটি সর্বদলীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় “সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ” গঠিত হয়। এ সভায় স্থির হয় যে, ২১শে ফেব্রুয়ারী প্রদেশব্যাপী “রাষ্ট্রভাষা দিবস” পালন করা হবে।

১৯৫২ইং সালের ২১শে ফেব্রুয়রী "রাষ্ট্রভাষা দিবস" কর্মসূচী কে সফল করে তোলার জন্য ৪ঠা ফেব্রুয়ারী হরতাল এবং ১১ ও ১৩ই ফেব্রুয়ারী সাফল্যের সাথে “পতাকা দিবস” পালিত হয়।
রাষ্ট্রভাষা বাংলা ও রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে কারাগারে আটক অবস্থায় ১৬ই ফেব্রুয়ারী শেখ মুজিবর রহমান এবং আওয়ামীলীগ নেতা মহিউদ্দিন আহমেদ আমরন অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। অন্যদিকে “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” ব্যাজ বিক্রি করে ২১শে ফেব্রুয়ারী রাষ্ট্রভাষা দিবস পালনের জন্যে ছাত্র-ছাত্রীরা অর্থ সংগ্রহ শুরু করে।

ক্ষমতাসীন নুরুল আমিন সরকার ২০শে ফেব্রুয়ারী আকস্মিক এক ঘোষনার মাধ্যমে ঐদিন বিকেল থেকে ঢাকা শহরে পরবর্তী একমাসের জন্যে ১৪৪ ধারা জারী করে সকল প্রকার সভা, শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ ঘোষনা করেন। মুলত ২১শে ফেব্রুয়ারী সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পূর্ব ঘোষিত হরতালকে প্রতিহত করতেই ২০শে ফেব্রুয়ারী সন্ধ্যায় এই ১৪৪ ধারা জারী করা হয়।

পহেলা ফেব্রুয়ারী থেকেই হরতাল সফল করার প্রস্তুতি নেয়া হয় কিন্তু হঠাৎ করে সরকারের এ ১৪৪ ধারা ঘোষনার কারনে ছাত্রনেতারা হতাশ হয়ে পড়েন। সে সময় তারা হরতাল বাতিল ও ১৪৪ ধারা না ভাঙার সিদ্ধান্ত নেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী রাত ১০ টার দিকে এই সিদ্ধান্তের কথা মাইকিং করে জানিয়ে দেয়া হয়।
একই দিকে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কর্মপরিষদের সদস্য নন এমন কয়েকজন নেতা কে জানিয়ে দেয়া হয় যে, রাতেই তৎকালীন ঢাকা হলের পুকুড়ের পূর্ব পাড়ের সিড়িতে জরুরী গোপন বৈঠক হবে।
রাত ১২ টায় অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন: গাজিউল হক (আইনজীবী), হাবিবুর রমান (বিচার পতি) মোহাম্মদ সুলতান, এম,আর আখতার মুকুল, জিল্লুর রহমান, আব্দুল মোমিন, এস এ বারী, সৈয়দ কামরুদ্দীন হোসেইন শহুদ, আনোয়ারুল হক খান, মঞ্জুর হোসেন ও আনায়ার হোসেন।

বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় পরের দিন আমতলা'য় (এখন যেটা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগ, সেখানেই ছিল আমতলা) সভা অনুষ্ঠিত হবে। ছাত্রনেতা গাজীউল হকের সভাপতিত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবন প্রাঙ্গনে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে শোভাযাত্রা সহ মায়ের ভাষা বাংলা কে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি পেশ করার জন্য প্রাদেশিক পরিষদ ভবনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। যদি গাজীউল হক গ্রেফতার হন তবে সভাপতিত্ব করবেন এম আর অখতার মুকুল এবং তাকেও যদি গ্রেফতার করা হয় তবে সভাপতিত্ব করবেন কামরুদ্দীন শহুদ। এ সময় আরও সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, সভাপতি হিসাবে গাজিউল হক ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে বক্তব্য রাখবেন এবং ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে সিদ্ধান্ত জানিয়ে সভার কাজ শেষ করবেন।

২০শে ফেব্রুয়ারী রাতে হরতাল প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় পরদিন সবকিছুই ছিল স্বাভাবিক। শুধু বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেডিয়াম মাঠটিতে সকাল থেকে কয়েক হাজার পুলিশ জামায়েত হতে থাকে। সঙ্গে থাকে পুলিশের স্পেশাল টিয়ার গ্যাস স্কোয়াড।
২১শে ফেব্রুয়ারী, বৃহস্পতিবার, ১৯৫২ সাল।
গাজিউল হককে সভাপতি করে সভা শুরু হয়। প্রথম বক্তব্য রাখেন সর্বদলীয় কর্ম পরিষদেও সদস্য শামসুল হক, তিনি ১৪৪ ধারা না ভাঙার পক্ষে বক্তব্য রাখেন। যদিও তিনি বক্তব্যের শেষে আন্দোলনের প্রতি পূর্ন সমর্থন ব্যক্ত করেন। এরই মধ্যে খবর আসে, লালবাগ এলাকায় স্কুল শিক্ষার্থীদের উপর পুলিশের টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ ও লাঠি চার্জ করছে। ফলে উত্তেজনা তখন চরমে ওঠে। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক

আব্দুল মতিন এবং সভাপতি গাজিউল হক উভয়েই ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে বক্তব্য রাখেন এবং তা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। চার দিক কাপিয়ে শ্লোগান ওঠে ১৪৪ ধারা মানি না, মানবো না। এই শ্লোগান চলার সময় আবদুস সামাদ আজাদ কী ভাবে ১৪৪ ধারা ভাঙা হবে তার একটি প্রস্তাব পেশ করেন। এ প্রস্তাব কে বলা হয় বিখ্যাত ১০ জনী মিছিল। তার মতে হাজার হাজার শিক্ষার্থী একত্রে মিছিলে নামলে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। তাই প্রতি দফায় ১০ জন করে রাস্তায় মিছিল বের করবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রক্টর মুজাফফর আহমেদ চৌধুরী এ বক্তব্য সমর্থন করেন এবং কলাভবনের গেট খুলে দেয়ার নির্দেশ দেন।

এরপর শুরু হয় ছাত্র-ছাত্রীদের ১০ জনের মিছিল। প্রথম দলের নেতৃত্বে ছিলেন হাবীবুর রহমান (পরবর্তী কালে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচার পতি ও তত্ত্বাবধায়ক প্রধান উপদেষ্টা এবং পরে রাষ্ট্রপতি)। দ্বিতীয় দলে ছিলেন আবদুস সামাদ আজাদ ও ইব্রাহীম তাহা। তৃতীয় দলে আনোয়ারুল হক খান এবং আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ খান। এই ১০ জনের মিছিলে যারা গ্রেফতার হচ্ছিল তাদের তালিকা তৈরীর দায়িত্বে ছিলেন মোহাম্মদ সুলতান এবং কাজী আজাহার। চতুর্থ দফায় মেয়েদের একটি মিছিল স্বেচ্ছায় কারাবরনের উদ্দেশ্যে রাস্তায় নেমে আসার পরপরই ছাত্রদের অনেক গুলো মিছিল একে একে বের হয়ে আসতে শুরু করে। সকাল সাড়ে ৮ টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে গেটের সশস্র পুলিশ প্রহরা ভেদ করে অসংখ্য দলে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা ছোট ছোট শোভাযাত্রা সহকারে ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের পুরানো কলা ভবন প্রাঙ্গনে মিলিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন হলের ছাত্র-ছাত্রীদের ছোট ছোট মিছিলও চারপাশ থেকে এসে জমা হতে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে।

বেলা সাড়ে ১১ টার দিকে ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যা দাড়ায় প্রায় ১০ হাজারে। শান্তিপূর্ন মিছিলে ছাত্র-ছাত্রীদের মুখে ছিল একটাই শ্লোগান, 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’।

নিজস্ব অবস্থানে নির্দেশের জন্য অপেক্ষায় থাকা পুলিশ আকস্মিক ভাবে মিছিলের উপর লাঠিচার্জ ও অবিরাম কাদানো গ্যাস নিক্ষেপ করতে শুরু করে। কাদানো গ্যাসের ধোয়ায় ছেয়ে যায় চাদিক। ছাত্ররা দৌড়ে কলা ভবনের পুকুড়ে এসে রুমাল ভিজিয়ে চোখ মুছে আবার মিছিলে যোগ দেয়। এমনি সময়ে একটি টিয়ারশেল সরাসরি গাজিউল হকের বুকে এসে আঘাত করলে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দোতলায় মেয়েদের কমন রুমে তাকে রেখে আসা হয়। কলাভবন এলাকায় ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষ চলতে থাকে, তখন সময় বেলা প্রায় ২টা।
ঢাকার অন্যান্য স্থানে সবকিছু প্রায় স্বাভাবিক থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়

এলাকায় চলতে থাকে পুলিশের লাঠিচার্জ আর ছাত্রদের ইট-পাটকেল নিক্ষেপ। এ পরিস্থিতিতে ছাত্ররা যাতায়াতের সুবিধার জন্য কলা ভবন ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মধ্যবর্তী দেয়াল ভেঙে ফেলে। এর কিছুক্ষনের মধ্যেই পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদের সংঘর্ষের দিক পরিবর্তিত হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় পুলিশের বেপরোয়া লাঠিচর্জে আহত হন বহু ছাত্র। ছাত্র-ছাত্রীদের মিছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে পৌছালে কোন পূর্ব সংকেত ছাড়াই জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কোরেশির নির্দেশে সশস্র পুলিশ দৌড়ে এসে জগন্নাথ হল প্রাঙ্গনে অবস্থান নিয়ে গুলিবর্ষন শুরু করে। চারদিকে টিয়ার গ্যাসের ধোয়ার ভেতর কিছু বুঝে ওঠার আগেই পুলিশ নির্বিচারে গুলিবর্ষনে রফিক, শফিক, সালাম, বরকাত ও জব্বার সহ নাম না জানা অনেকে নিহত হয় এবং ক’য়েক শ ছাত্র-ছাত্রী আহত হয়। বাংলার জাতীয় ইতিহাসে রচিত হয় এক রক্তাক্ত অধ্যায়। তখন সময় বেলা ৩ টা ১০মিনিট।

ছাত্রদের মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষনের ঘটনা ঢাকায় ছড়িয়ে পড়লে হাজার হাজার সাধারণ জনতা ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে জড়ো হতে থাকে। গুলি বর্ষনের সংবাদ আইন পরিষদে পৌছালে ধীরেন্দ্র নাথ দত্তের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার ৬ জন আইন পরিষদ সদস্য আইন পরিষদ মূলতবী করে ঢাকা মেডিকেল কলেজে আহত ছাত্রদের দেখতে যাবার জন্য নুরুল আমীনকে অনুরোধ করেন। সরকারী দলের সদস্য আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশও এই প্রস্তাবের সপক্ষে উচ্চকন্ঠ হন। কিন্তু নূরুল আমীন সকল দাবি উপেক্ষা করে আইন পরিষদের অধিবেশন চালানোর নির্দেশ দেন। এর প্রতিবাদে পূর্ব বাংলার সদস্যরা পরিষদ ওয়াক আউট করেন।
রাতের বেলা ছাত্র নেতৃবৃন্দের উদ্যোগে ঢাকা শহরের প্রতিটি মসজিদে ও কাবে পরদিন সকালে পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জমায়েত হবার আহ্বান সম্বলিত লিফলেট বিলি করা হয়।

পুলিশের গুলিতে নিহত একটি লাশের মাথার অর্ধেকটাই গুলিতে উড়ে যায়। পরে জানা যায়, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র আবুল বরকত। সে সময় পর্যন্ত ঘটনাস্থলে নিহতের সংখ্যা ছিল ২ এবং আহত ৯৬। সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে মারা যান শহীদ জব্বার ও রফিক উদ্দিন। শহীদ সালাম ছিলেন বাদামতলী একটি প্রেসের কর্মচারী। তাছাড়া অহিউল্লাহ নামে ৯ বছরের একটি শিশু পুলিশের গুলিতে মারা যায়।
উল্লেখ্য, অব্দুস সালাম ২১শে ফেব্রুয়ারী ১৪৪ ধারা ভঙ্গের মিছিলে অংশ নিয়ে পুলিশের গুলিতে আহত হন। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পিতার উপস্থিতিতে ২৫শে ফেব্রুয়ারী বেলা সাড়ে ১১টায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন (সরকারী গেজেট অনুসারে ৭ই এপ্রিল ১৯৫২ইং)। ২৬শে ফেব্রুয়ারী বিকাল ৪টার দিকে সালামের লাশ ঢাকাস্থ আজিমপুর গোরস্থানে নেওয়া হয়।