তোমাদের সুখ দেখাও

“লন্ড্রি গুলো নিয়ে আসবে?” “আমি এখন যাবো না, এখন ইচ্ছা করছে” গভীর মনোযোগে আমি ফেসবুক দেখতে থাকি। সোমা, আমার বউ, বিরক্ত হয়। এরপর বিরক্তি চেপে নিজেই লন্ড্রি আনতে চলে গেলো। প্রতিদিন সে বাথ্রুম পরিস্কার করে, রান্নাঘর গোছায়, যন্ত করে ড্রয়িং রুম সাজায় আমাদের বন্ধুদের মুগ্ধ করার জন্য। এমনকি শোবার ঘরের বিছানাটাও টান টান থাকে অতিথিদের জন্য। সোমা খুব লক্ষী মেয়ে। খুব চেষ্টা করে সংসারটা ঠিক রাখার জন্য। আমাদের ছেলে সোহান আর রিতিও মায়ের যত্নে আদরে মানুষ হচ্ছে। খুব আটপৌরে সংসার আমাদের। অফিস খাওয়া ঘুম, মাঝেমধ্যে সেক্স, বেড়ানো, দাওয়াত। মাঝে মাঝে সোমাকে দেখি ড্রয়িং রুমে উদাস মুখে তাকিয়ে জানালায় বৃষ্টি দেখে। আমি সব লক্ষ্য করি। কিন্তু আমার ফেসবুকের নেশা আমাকে তার পাশে বসায় না। আমি নিজের ল্যাপটপে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। ফেসবুকে সারাক্ষণ কিছু না কিছু ঘটছে। দূরদেশের ঘূর্ণিঝড়,বন্যা, যুদ্ধ, অন্যায়, অবিচার আমাকে বিচলিত করে। রাজনীতি নিয়ে আমি বন্ধুদের সাথে তর্ক করি। বন্ধুদের শেয়ার করা তাদের তোলা নিখুত ছবি দেখে আমি ঈর্ষান্বিত হই। আমি অবশ্য সোমাকে সাহায্য করার চেষ্টা করি। সে টিভি সিরিয়াল বা ফেসবুকে শাড়ি দেখায় মগ্ন থাকলে আমি বাসনকাসন ধোয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু বছরের পর বছর সংসারে আমি টের পাই আঠা আঠা প্রেমটা কমে আসছে। সোমার নিটোল চেহারা দেখে আমি প্রেমে পড়ি ছিলাম। আমাকে দেখেও তার চোখে যে তারা জ্বলে উঠতো সেটা দেখতেও ভালোবাসতাম আমি। ইউনিভার্সিটির বন্ধুদের আড্ডায় কথাবার্তা, তারপর একসাথে কফি খাওয়া, এরপর ধীরে ধীরে প্রেম। যখন বিয়ে হলো, খুব মাখো মাখো প্রেম ছিলো আমাদের। সারারাত আদরের পর জড়িয়ে ধরে অর্থহীন প্রেমের আলাপ। ভবিষৎ নিয়ে প্রেমের কল্পনা। সোমার সুখী সংসারের ছবি, আমাদের একটা নিজস্ববাড়ির স্বপ্ন, আমার ওয়ার্ল্ড ট্যুরের প্ল্যান। কতো কিছুই না আলাপ করতাম আমরা বন্ধুর মতো। সে সময়টা খুব সুখের ছিলো। আমরা একত্রে লণ্ড্রি করতে যেতাম। রান্নাতে সাহায্য করতাম। তখন সোহান আর রিতি আমাদের সংসারে আসেনি। সোমার সবটুকু সময় আমার জন্য ব্যয় করতো, আমিও রাজাধিরাজের মতো তার পূর্ণ মনোযোগ উপভোগ করতাম। বছরের বছরের বাস্তবতায় প্রেমের আঠা কমে এসেছে। এখন শুধু রুটিন জীবন। সোমার যখন বৃষ্টি দেখে তখন তার চোখের ভিতর আমি স্বপ্নের বদলে শূন্যতা দেখতে পাই। অথচ আমরা ঠিক অসুখী না। শুধু আমাদের আবহ সঙ্গীতটা বন্ধ হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে সোমা খুব বিরক্ত হয়। বিরক্ত হলে সে বিছানা থেকে আর উঠতে চায় না। ৭ দিন সে বিছানায় কাটিয়ে দেয়। আমি যতোটুকু সম্ভব করার চেষ্টা করি। ঘরের অবস্থা তখন বিভৎস রুপ নেয়। আমি ফেসবুক ছাড়ার চেষ্টা করি, কিন্তু বাস্তব জগত আমাকে আর আকর্ষন করে না। মাঝে মাঝে আমি সোমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাই। সোমা স্বভাববশত তার মুখ তুলে দেয়। কিন্তু তরকারীতে লবন ঠিকঠাক না হলে যেরকম অতৃপ্তি লাগে, সোমাকে চুমু খেয়ে তেমনটা লাগে আমার। কি যেন একটা সমস্যা, কি যেনো একটা মিসিং। আমি একসময় ফেসবুক বন্ধ করি, সোমা নিয়ে বেড়াতে বের হই। বাচ্চাগুলোকে বন্ধুর বাসায় রেখে আমরা একা একা ঘুরে বেড়াই, সৈকতে, বনে। ভালো লাগে হাত ধরে হাটতে। সোমা ক্লান্ত হয়। আবারো বৃষ্টির দিনে ওর চোখে শূন্যতা দেখি আমি। বাইরে থেকে দেখতে আমরা একটা সাধারন সুখী পরিবার। কিন্তু আমি ভয় পাই, সম্ভবত কোন গহীন কুয়ার মতো সমস্যা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আমি ভাবতে শুরু করি। একদিন প্রযুক্তি আমার আর সোমার জন্য আশীর্বাদ নিয়ে আসে। আমাদের ডাইনিং রুমের টেবিলটা কিচেনের সাথে লাগোয়া। ডাইনিং রুমের উপর আমি আর্টিফিসিয়াল আই - টা বসাই। ওখান থেকে সে আমাদের দেখতে পারে। সোমা কৌতুহলী হয়। আমি সোমাকে রান্নাঘরে সাহায্য করি। আমরা এক সাথে রান্না করি দীর্ঘ একযুগ পর। আমি তরকারি কেটে দেই, সোমা নিমিষেই একটা ফ্রাইং প্যানে বিভিন্ন তরকারী ভেজে ফেলে। সোমার হাতের রান্না খুবই চমৎকার। আমরা গল্প করতে করতে রান্না করি। আমি মিউজিক ছেড়ে দেই হাল্কা ভলিউমে। আর্টিফিশিয়াল আইটা আমাদের দেখতে থাকে। ওর নাম দিয়েছি আমি নয়ন ভাই। আর সোমা ওকে ডাকে সুনয়না ভাবী। আমরা রান্না করতে খুনসুটি করি, সেই প্রথম দিকের প্রেমের দিনের মতো। নয়ন ভাই আমাদের বলে, বাহ আপনাদের তো চমৎকার প্রেম। আমরা খেতে বসি। নয়ন ভাইকে আমাদের রান্নার ছবি দেখাই। সুনয়না ভাবী আমাদের বলে সোমা ভাবী আপনার খাবারের কালারটা খুবই সুন্দর। খেতেও নিশ্চয়ই মজা হয়েছে। সোমা খুব খুশী হয়। খাবার আসলেই মজা হয়েছে। যদিও আমরা নাস্তিক, সোমা কিছুটা সমাজভীড়ু, তারপরো খোদাতালার রহমত আমাদের খাবারের উপর ভর করে। আমি সোমার খাবারের প্রশংসা করি, সোমা আমাকে সাহায্য করার জন্য ধন্যবাদ দেয়। এরপর নয়নভাই/সুনয়নাভাবীকে আমরা খাবারের টেবিলের উপর রেখে দেই। সোমার সাথে আমি সিনেমার গল্প করি, গানের গল্প করি। নতুন বই পড়ার কিনে আলাপ করি সেটা নিয়ে। নয়ন ভাই তার সুচিন্তিত রিভিউ দেয় সেগুলো নিয়ে। সুনয়না ভাবী একদিন বলে তোমাদের সংসার দেখে যে কারো হিংসে হবে। শুনে সোমার খুব আহলাদ হয়। একদিন বৃষ্টির দিনে, সোমার যখন শূন্য দৃষ্টিতে বৃষ্টি দেখছিলো, আমি ওকে ঝাপটে ধরে আদর করি। অনেক অনেক আদরের পর সোমার চোখে আবার আমি ভালোবাসার তারা গুলো দেখতে পাই। সেই প্রথম প্রেমের দিন গুলোর মতো।