শৃঙ্খলগ্রস্তের বিশৃঙ্খল ডায়েরী - ৮

অস্বস্তিটা অনেকটা এমন যেন টিপ টিপ করে পুরানো কল গড়িয়ে পড়া পানির মতো। একঘেয়ে টিপ টিপ শব্দ। সব মৃত্যু যে খুব জানান দিয়ে হবে এমনটা নয়। ধীরে ধীরে টিপ করে গড়িয়ে পড়া পানির মতোও মৃত্যু হয়। সবার অগোচারে ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাওয়া বুনো হাড়ের মতো মৃত্যু। অদ্ভূত ভরহীন সময়ে বাস করছি আজকাল। একটা ছেড়া পাতা কিংবা পাখীর পালকের মতো সময় এখন। হাওয়া যেখানে যাচ্ছে সেখানেই ভেসে যাচ্ছি। এতোই ভরহীন সময়, নিজের হাত পা মুখ স্পর্শ করে ঠাহর করতে পারছি না। বোধহীন ভোতা হয়ে যাওয়া সময়। অথচ আমাদের সময়টা ছিলো সবচে আশাপ্রবণ, সবচে উন্নত সময়। সমস্ত পৃথিবীর সব ফসল আমরা সবচে ক্ষুধার্তের মুখে তুলে দিয়েছি। মানুষকে নিয়ে এসছে তার আঙ্গুলের স্পর্শের কাছাকাছি। পৃথিবীর সব স্বপ্নকে সফল করে দিয়েছি আমরা। সবাই এখন সুখী। সবার পেট ভরপুর। সবার চোখ পূর্ণ কাল্পনিক বিনোদনে। সবার পরিবারে দুটা সন্তান। একটা ছেলে আর একটা মেয়ে। সবার সুখী সুখী স্বপ্ন হলো সত্য ইটের পর ইটের মতো একটা করে বাড়ি আছে। সবাই তাদের সুখ জাহির করতে সুখী সুখী চেহারা অন্যদের দেখাতে উন্মুখ। এখন তো সুখী হবার সময় ছিলো। তারপরো আমরা কেনো ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাচ্ছি ভোতা অনুভূতির অন্ধ সময়ে? অনেকের বুকের ভিতরে কৃষ্ণগহবরের মতো একটা অন্ধকূপ থাকে। সবকিছুকে আকর্ষিত করে সেটা। সময়, আলো, সুখ, স্বপ্ন, আশা, জীবন, যৌবন, কীর্তি, প্রেম সব কিছুকে আকর্ষিত করে। আর সেই কৃষ্ণগহবরে ভিতর সব কিছু ডুবে যায়। কখনো ফেরে না কিছু। গহীন আকর্ষনে ডুবে, আলোও সেখান থেকে ঠিকরে বের হতে পারে না। আলো অন্ধকারের মেটামরফসিস হয় তাদের বুকের ভিতরে। আমার বুকের মাঝে টিপ টিপ করে সময় গড়িয়ে পড়ে। সময়ের ফোটা গুলো একঘেয়ে ভাবে আমার মুখের উপর পড়তে থাকে। আমি টর্চার করা আসামীর মতো মুখের উপর থেকে অন্ধত্বের চাদরটা সরাতে চেষ্টা করি। সময়ের ফোটা গুলো আমার চিবুক স্পর্শ করে আমার বুকে গহীনে মিলিয়ে যায়। আমি টের পাই একটা অন্ধকূপ সৃষ্টির সময় আলামত তৈরি হচ্ছে আমার বুকে ভিতরে। তোমার ছোটবেলার একটা ছবি হাতে এসেছে আমার দূরবর্তী ডাকবার্তা থেকে। হাসিমুখে নাচের মুদ্রায় তুমি। তোমার আধো আধো হাসিতে কিছুটা ইনোসেন্স আছে কিছুটা অভিযোগ আছে। আমি স্পর্শ করতেই ছবি থেকে বের হয়ে নাচতে শুরু করো তুমি। ছোট্ট একটা ডলপুতুলের মতো আমার টেবিলের উপর নাচো তুমি। খুব সুখী সুখী লাগছিলো তোমাকে। অদ্ভুত একটা আলোর আভা ছড়িয়ে পড়ে আমার টেবিল জুড়ে। পরের দিন গভীর রাতে স্যাটেলাইট থেকে তোলা ফটোতে পৃথিবীর সবচে উজ্জল আলোকবিন্দু বলে ধরা পড়ে আমার টেবিলের পাশের জানালাটা। আমি তোমার ছোট্ট গালটা স্পর্শ করার চেষ্টা করি।ঠান্ডা অনুভূতিহীন স্পর্শ। আমি কিছুই অনুভব করতে পারি না। আমার আঙ্গুল গুলো অনুভূতিহীন অসাড় হয়ে গেছে। ছোট্ট তোমার হাত গুলো আমার গাল স্পর্শ করে। আমার খড়ে খড়ে খোচা দাড়িতে হাত বুলায়। আবার নাচের মুদ্রায় ফিরে যায় আমার ছোট্ট ডলপুতুল। আমার বুকের অন্ধকূপটা সব আলো শুষে নিতে থাকে। তোমার ছোট হাতটা আমার বুকের রাখো তুমি আর সময় কিছুটা থমকে যায়।