অন্তহীন

Imtiaz Mirza


একদেশে একটা ছেলে ছিলো আর একটা মেয়ে ছিলো, যেমন করে আর সব গল্পের মধ্যে একটা ছেলে আরেকটা মেয়ে থাকে। ওদের মধ্যে অনেক প্রেম, সত্যিকারের প্রেম,রাত দুপুরে টইটুম্বর পুকুরে মাছের ঘাই এর মতো প্রেম । দিনরাত চিঠি চালাচালি ওদের, দীর্ঘশ্বাস আর এলোমেলো কথা ভর্তি চিঠি, যেসব চিঠি মানুষ গোপন ড্রয়ারের সাজিয়ে রাখে নষ্টালজিক হবার জন্য। আঙ্গুল জড়িয়ে গিট পাকায় ওরা, যেমন করে প্রেমিকার শরীরকে প্রেমিক আদর করে তেমন করে। রেস্টুরেন্ট টেবিলের তলা দিয়ে পা স্পর্শ করে, যেমন করে গোটা পৃথিবী চেয়ে থাকার পরও প্রেমিকযুগল স্পর্শ করে আর তারপর লজ্জা পায় তেমন । দেয়ালে হার্ট একে তার ভিতর নাম লেখা, স্কুলবয়রা যেমন করে গাছের বুকে লিখে রাখে নাম তেমন করে। একে অপরের চোখের দিকে তাকিয়ে বুদ হয়ে যায় , মাঝদুপুরে আয়নার মাঝে তরুণী যেমন বুদ হয়ে যায় তেমন। চুলের ঘ্রাণ নেয় , সতেজ হাওয়ায় খুব ভোরে যেমন প্রভাতযাত্রী সকালের ঘ্রাণ নেয় তেমন। ছোট ছোট চুমু খায় , যেমন স্কুলবালিকারা প্রথম চুমু খায় আনাড়ির মতো। জড়িয়ে ধরে রাখে, প্রিয় পুতুলকে যেমন বাচ্চা মেয়েরা জড়িয়ে ধরে রাখে । বিদায়ের সময় কেবল বাহানা বানিয়ে দেরী করে, খুব ঘনিষ্ঠ আত্মীয়রা দরজায় দাঁড়িয়ে যেমন গল্প করে দেরীর বাহানা করে তেমন। সবই ছিলো ওদের মাঝে । ওরা স্বপ্ন দেখছিলো । ঘর বাধার স্বপ্ন, ভালোবাসার স্বপ্ন - রৌদ্রউজ্জল দিনে বাড়ীর পিছনের বাগানের মতো স্বপ্ন ছিলো। 
 
ছেলেটি ফিসফিস করে মেয়েটিকে বলছিলো , তোমাকে একটা ছোট সুন্দর ঘর বেধে দিবো । দিনরাত আমরা একে অপরকে ভালোবাসবো। মেয়েটি ছেলেটির চোখের দিকে তাকিয়ে সম্মতি জানিয়েছিলো। পরম বিশ্বাসে বুকে মাথা রেখেছিলো। মেয়েটি বলেছিলো আমাদের বাবু হবে তোমার আর আমার মতো, ভিউকার্ডের মতো ফ্যামেলি ফটো হবে আমাদের । এরপর একদিন সত্যি সত্যি ছেলেটি একটা ঘর বেধে ফেলে একটা ছোট্ট সুন্দর সংসার। যেনো পেইন্টিং আকা ছোট্ট সুখের ঘর । ওরা বড়ো সুখে ছিলো, দুটো কবুতর গা ঘেসে যেমন ওম ওম শব্দ করে তেমন সুখে ছিলো তারা । একদিন ছেলেটিকে সরকারী অফিসাররা ডেকে নিয়ে যায়, সরকারী অফিসাররা যেমন লাইসেন্সধারী গুন্ডা হয় , সেইসব অফিসাররা । বলে তোমাদের এই ঘরটা অবৈধ, দেশদ্রোহীদের মতো অবৈধ । এর অর্ধেকটা সরকার বাহাদুর নিয়ে নিবে, যে সরকার মানুষের কল্যাণ আর উন্নয়নে বিশ্বাসী , উন্নয়নের জন্য তোমার ঘরের অর্ধেকটা লাগবে। ছেলেটা মেয়েটিকে বলে , আচ্ছা আমরা বাকী অর্ধেকটায় ভালোবাসবো । মেয়েটা ছেলেটার চোখের দিকে তাকায় , সে চোখে যন্ত্রণা দেখে , তারপর তার ঠোটে চুমু খায় । ওরা আবার তাদের অর্ধেক ঘরটাই সাজাতে শুরু করে , যেমন এসিডে ঝলসানো নারী তার মুখে লিপস্টিক দেয় তেমন করে । এরপর একদিন জলচ্ছাস আসে , যেভাবে মানুষের জীবনে দুর্যোগ আর দুর্ভোগ আসে , জানান না দিয়ে তেমন ভাবে। ওদের ঘর আধ খানা ঘর ভেসে যায় , ডুবে যায় , ঠিক যেমন করে মানুষের শেষ আশাভরসাটাও ডুবে যায় রাতের গহীন অন্ধকারে। ছেলেটা মেয়েটিকে বলে , সমস্যা নেই , আমরা ঘরের ছাদে ভালোবাসাবাসি করবো, একটু হাসে সে , যেমন করে দুঃখের সময় হাসে মানুষে সেভাবে । মেয়েটা ছেলেটার চোখের দিকে তাকায় , সেখানে অনিশ্চিত দেখতে পায়, যেমন করে দূরের আকাশে ঝড় দেখে মানুষ অনিশ্চিত হয় । মেয়েটা ছেলেটার হাত ধরে , তারপর বলে আচ্ছা , আমরা ঘরের ছাদেই নতুন করে ঘর বাধবো । ওরা আবার ভালোবাসাবাসি শুরু করে , আদর করে অনেক, যেমন করে একটা শঙ্খচূড় আরেকটা শঙ্খচূরকে জড়িয়ে ধরে সেভাবে।
কিছুদিন পর ছেলেটিকে পানি ঠেলে ভেলা বানিয়ে কাজে যেতে হয়, জলাবদ্ধতা পেরিয়ে, যেমন করে মানুষ তার জীবন পারি দেয় সব দুঃসংবাদের উপর ভেসে ভেসে। কঠোর পরিশ্রম করে ছেলেটি, যেমন করে আর কোটি কোটি মানুষ যারা ভাবে তাদের জীবন পরিবর্তন হবে পরিশ্রম করলেই , লটারীর টিকেটের মতো কঠোর পরিশ্রম করে তাদের ভাগ্য পরিবর্তিত হয়ে যাবে তেমন করে। 
 
মেয়েটিও তাদের ছাদের ছোট্ট সংসার সুখী রাখতে চেষ্টা করে, যেমন করে সুখী সুখী গৃহকর্ত্রীরা তাদের ময়লা গুলো কার্পেটের নিচে লুকিয়ে ফেলে সেভাবে। ওদের একটা বাচ্চা হয়, ঠিক যেমন ছোট্ট বাচ্চা হয় সবার , যেন অসংখ্য মানুষের ফটো এ্যালবাম থেকে তুলে আনা হয়েছে বাচ্চাটাকে । একদিন বাচ্চাটা মারা যায়, যেভাবে বাচ্চারা মারা যায়, নিথর হয়ে , অনেকগুলো বুককে নিথর করে। মেয়েটা স্তব্ধ হয়ে যায় । ছেলেটা মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে রাখে, যদিও বাচ্চাটার ঠান্ডা অদৃশ্য দেহটা দুজনের মাঝে জমে থাকে । ওকে বলে, আমি তো আছি , আমি থাকবো , আমি তোমাকে ভালোবাসবো । ছেলেটা রোজ কাজে যায় , কঠোর পরিশ্রম করে ছেলেটা , স্বপ্ন দেখে একদিন সফলভাবে বুড়ো হবে সে। একদিন একটা দুর্ঘটনায় তার ডানহাতটা হারায় সে, যেভাবে মানুষ তার জীবনের শেষ অবলম্বন হারিয়ে রাস্তায় নেমে আসে , সেভাবে । মেয়েটা ছুটে আসে, যেভাবে নাটক আর সিনেমার নায়িকারা দৌড়ে আসে তাদের অভিনয় প্রতিভা দেখানোর জন্য। ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে, ভরসা পাওয়ার জন্য মানুষ যেভাবে জড়িয়ে ধরে সেইভাবে । ছেলেটা ম্লান হাসি হাসে, যেমন করে জীবন একটা গম্ভীর বিদ্রুপ বলার পর সিগারেট দু আঙ্গুল দিয়ে ছুড়ে ফেলার পর যে হাসি হাসা যায় অনেকটা তেমন । মেয়েটাকে বলে , আমার তো এক হাত আছে , একহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে তোমাকে ভালোবাসবো, এক হাতই যথেষ্ট ভালবাসার জন্য , এর বেশী কি আর চাই , যেমন করে তীব্র জীবনবোধ সম্পন্ন উপন্যাসের চরিত্ররা কথা বলে অনেকটা সেই ভাবেই। এরপরের ইতিহাস - স্বপ্নভঙ্গ, দুঃখ, বার্ধক্য, অনন্ত দুঃশ্চিন্তার ইতিহাস - যেমনটা আমাদের বেশীর মানুষের জীবন হয় তেমনটাই। এরপর একদিন ওরা দুজনেই মারা যায় একদিনেই , জমজ মৃত্যু , যেভাবে একটা যৌথসঙ্গীতের রেশ শেষ হয় সেইভাবেই।
 
ওদের ভালোবাসাটা বুদবুদের মতো আয়নোস্ফিয়ারকে স্পর্শ করে । এরপর ছড়িয়ে পড়ে সারা পৃথিবী জুড়ে। এখনো তার রেশ পাওয়া যায় এলোমেলো হাওয়া গাল ছুয়ে দিলেই । প্রাচীন হয়ে ওদের ভালোবাসাটা বেচে থাকে, পৃথিবীর মতো, অন্তহীন।