সমষ্টিগত ঘৃণার যোগফল

Imtiaz Mirza


ফটো জার্নালিস্ট উদাস চোখে হাটা হাটি করছেন। আজকে দিনটা অনেক ভ্যাপসা গরম। এছাড়া মনের মতো কোন ছবি তুলতে পারেনি সে। আজকাল মানুষের অনুভূতি অনেক ভোতা হয়ে গেছে। সহজে এডিটরকে সন্তুষ্ট করা যায় না। জোরালো ধাক্কা দেয়া ছবি না হলে আজকেও তাকে কথা শুনতে হবে। 
সামনেই একটা জটলা দেখে দ্রুত পা চালালো সে। ক্যামারের শাটারের ক্লিক ক্লিকে নিস্তব্ধ দুপুরটা খান খান হয়ে গেছে। একেক জন শুয়ে বসে ছবি তুলছে। লাশের গা ছুয়ে দিতে পারে ক্যামারা। লাশটার চেহারাটা দেখেই মুহুর্তের জন্য মন খারাপ হলো ফটো জার্নালিস্টের। ফুলের মতো চেহারার একটা বাচ্চা। ঠোটের কোন বেয়ে রক্ত শুকিয়ে জমাট বেধেছে। মন খারাপটা দ্রুতই ঝেড়ে ফেলে কাজে লেগে গেলো সে। সরাসরি চেহারা ছবি তুললো। জুম করে ছবি তুললো। এরপর এক পাশের ভিড় কমে যেতেই দুরের হলুদ ফুল গুলোকে ব্যাকগ্রাউণ্ডে রেখে একটা ছবি তুললো। ছবিটা দেখেই মনে হলো একটা কাব্যিক ব্যাকগ্রাউন্ড হয়েছে। এরপর খুশী মনে এডিটরের জ্বলজ্বলে হাসি কল্পনা করতে করতে সে অফিসের দিকে রওনা দিলো। ___ এডিটর প্রিন্ট করা ছবি দেখে সত্যি সত্যি পিঠ চাপরে দিলেন। 
 আজকে নূন্যতম ৫০,০০০ পেজ ভিউ হবে ছবিটা। সোস্যাল মিডিয়াতে ২০০০ কান্নার ইমো পাওয়া যাবে, ১০০০০ রিএ্যাকশন। এমনকি প্রিন্ট মিডিয়াতে ছবিটা দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন। সংখ্যলঘু জাতি যারা আশ্রয় খুজছে তাদের ছবি দেখতে দেখে আহাজারি করতে মানুষ পছন্দ করে। অফিসের অলস গুলতানি আর কফির কাপে ফুলের মতো শিশুর চেহারাটা ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসলো ফটো জার্নালিস্টের মন থেকে। ___ এরপর দিন, সকালে সেলফোন খুলতে ঝুপ করে তার তোলা ছবিটাই এসে পড়লো তার সামনে। বিভিন্ন মিডিয়া তার ছবিটা পিক করেছে। ছবিটা সোস্যাল মিডিয়াতে ভাইরাল হয়ে গেছে। অফিসে ঢুকতে সবাই কনগ্রেটস দিলো। তার মেসেজের ইনবক্স মোটামুটি ভরে গেছে ছবিটা ব্যাপারে প্রশংসা আর তথ্য চেয়ে। অনেকেই সমবেদনা জানাচ্ছে। অনেকে শিশুটার পরিচয় জানতে চাইছে, অনেকে শিশুটার বাবা মাকে সাহায্য করতে চাইছে। ফটোজার্নালিস্টের মনে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হলো। গর্ব আর তৃপ্তি মিশ্রিত একটা অনুভূতি। শিশুটার মুখের শুকানোর রক্তটা তার নার্সিসিজমের বিজয় নিশান হয়ে উঠলো। পরের দিনই দেশের প্রধান নেতা তার ছবিটা হাতে নিয়ে বক্তব্য রাখলেন টিভিতে। তিনি বলছিলেন যারা সংখ্যালঘুদের গণহত্যার জন্য দায়ী তাদেরকে গুড়িয়ে দেয়া হবে। বোমা মেরে তাদেরকে নিশ্চিনহ করে দেয়া হবে। তাদেরকে সমুচিত শাস্তি দেয়া হবে। দেশের মানুষ আকুন্ঠ ভাবে এই বোমাবাজির পক্ষে সমর্থন জানালো। কিছু কিছু মানুষ বলতে চাইলো যুদ্ধ না শান্তি চাই, আলোচনার টেবিলে সমাধান চাই, তাদের কন্ঠ প্রবল জনমতের তোপে চাপা পড়ে গেলো। হলুদ ফুলের জাতীয়তাবাদী সেন্টিমেন্টে শিশুটার নিষ্পাপ চেহারাটা তাদের ঘৃণাকে উস্কে দিলো। প্রবল আলোচনা শুরু হলো দেশজুরে রক্তপিপাসু খুনী গুলোকে কিভাবে শায়েস্তা করা যায়। ___ একদিন সত্যি সত্যিই যুদ্ধ লেগে গেলো। টনকে টন বোমা ফেলা হলো শত্রুদের ঘাটিতে। একটা পুরো শহরকে কার্পেট বম্বিং করে ধ্বংস করে দেয়া হলো কারন সেখানে অস্ত্রাগার ছিলো। সিভিলিয়ানদের তোয়াক্কা করা হলো না। 
এর দু একদিন পরই আমাদের ফটোজার্নালিস্ট যুদ্ধবিধ্বস্ত শহরটিতে এ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে গেলো। তার বুক পকেটের তার তোলা বিখ্যাত শিশুটির ছবি ছিলো। শহরের ঠিক মাঝখানেই একটা এতিমখানা ছিলো। প্রায় হাজার খানেক এতিম শিশু সেখানে বাস করতো। বোমাটি মাঠের মাঝ খানে পড়ে বিস্ফোরিত হয়। চারিদিকে শিশুদের লাশ। ফটোজার্নালিস্ট যত্ন করে প্রতিটা শিশুর লাশের ছবি তুললো। এক পাশে তার তোলা হলুদ ফুলের ব্যাকগ্রাউন্ডে বিখ্যাত ছবিটা রেখে ছবি গুলো তুললো সে। ___ পরের দিন ইন্টারনেটে প্রায় অনেক গুলো শত্রু শিশু লাশের ছবি আর প্রতিটার পাশে রাখা হলুদ ফুলের ব্যাকগ্রাউন্ডে লাশ হওয়া শিশুটার বিখ্যাত ছবি ছাপা হলো। ক্যাপশন দেয়া হলো, “প্রতিশোধঃ তোমরা আমাদের একটা শিশুর লাশের বিখ্যাত ছবি দাও, আমরা তোমাদের হাজার শিশুর লাশ উপহার দিবো।” জাতীয়তাবাদী জনগোষ্ঠির পক্ষ থেকে এই শিরোনামের ব্যাপারে অবশ্য কোন প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেলো না।